রাঙামাটি । মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪ , ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাপ্তাই (রাঙামাটি) প্রতিনিধিঃ-

প্রকাশিত: ১৩:১৭, ২৭ অক্টোবর ২০২৩

কাপ্তাইয়ে আয়েশা বেগমের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

কাপ্তাইয়ে আয়েশা বেগমের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
কাস্টমারদের সাথে আয়েশা বেগম এবং জয়িতা নারী হিসাবে সম্মাননা।

কাপ্তাই উপজেলা সদরে কাপ্তাই-চট্টগ্রাম সড়কের কোল ঘেঁষে মর্জিনার মা’র খাবার হোটেল। হোটেলটি এক নামে পরিচিত। উপজেলায় সরকারি চাকরিজীবী কিংবা উপজেলা সদরে নানা কাজে আসা অধিকাংশ লোকজন দুপুরে এই হোটেলে খাবার খেয়ে তৃপ্তি লাভ করে। ঘরোয়া পরিবেশে রুচিশীল সুস্বাদু রান্নার জন্য এই এলাকায় মর্জিনার মা’র হোটেলের বেশ নাম ডাক রয়েছে। সেমিপাকা ছোট্ট পরিসরে গড়ে উঠা এই হোটেলটি কাস্টমারদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজতে গত বৃহস্পতিবার (২৬ অক্টোবর) মর্জিনার মা’র হোটেলে যাই। দুপুরে খাবারের জন্য খুব ভীড়ের এক ফাঁকে কথা হয় মর্জিনার মা'র সাথে।

তিনি বলেন, আমার আসল নাম আয়েশা বেগম। বাবার বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা বনগ্রামে। অল্প বয়সে বিয়ে হয় কুমিল্লার মোঃ ইউসুফের সাথে। তিনি চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। বিয়ের পর ১০ বছর চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় স্বামীসহ থাকতাম। কিন্তু স্বামীর চাকরি চলে যাবার পর আমরা কাপ্তাই উপজেলার বড়ইছড়িতে একটি খাস জমিতে বাড়ি করে বসবাস করতে থাকি। এই ফাঁকে কাপ্তাই সড়কের পাশে কাপ্তাই থানার উল্টো পাশে আমার স্বামী একটি ফার্নিচারের দোকান দেয়। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দোকানটি উচ্ছেদ করা হয়। তখন বেশ কষ্টে পড়ে যাই। উচ্ছেদের এক বছর পর ওই স্থানে আমরা খাবার হোটেলের ব্যবসা শুরু করি। হোটেলের নাম রাখি বড় মেয়ে মর্জিনার নামে। স্বামীসহ আমি ওই হোটেল চালাতাম। দোকান দেওয়ার ৩ বছরের মাথায় হঠাৎ স্ট্রোকে আমার স্বামী মারা যায়। তখন আমি দুই মেয়ে নিয়ে চোখে অন্ধকার দেখি। চিন্তা করলাম, নিজেই স্বামীর ব্যবসা চালিয়ে যাব। শুরু হলো আমার জীবন সংগ্রাম। স্বামী মারা যাবার আগে এক মেয়েকে বিয়ে দিলেও অন্য মেয়েকে বিয়ে দেই স্বামী মারা যাবার পর।

দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আয়েশা বেগম আরও বলেন, প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজে দোকানের জন্য বাজার করে, নিজেই ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করি।

এক্ষেত্রে আমাকে সহযোগিতা করার জন্য একজন মহিলা রেখেছি। বেলা ১২টা থেকে কাস্টমার আসা শুরু করে। টানা প্রায় ৪টা পর্যন্ত কাস্টমারের ভিড় লেগে থাকে। একদম বিশ্রাম পাইনা দুপুরে। বিশেষ করে উপজেলা প্রশাসনে চাকুরিজীবী এবং প্রশাসনিক কাজে আসা লোকজন বেশী আসে আমার হোটেলে। ভর্তা, নানা রকম মাছ, বিভিন্ন পদের মাংস আমি নিজেই রান্না করে বিক্রি করি। তবে রাতে কাস্টমার কম হয়। লোকজন যখন খেয়ে আমার রান্নার প্রশংসা করে, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই। প্রতিদিন গড়ে আমি ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করি। আমার সংসারে এখন অভাব নেই। আমি এখন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। তাই অর্থনৈতিক ভাবে সাফল্য অর্জনকারী হিসাবে ২০২১ সালে কাপ্তাই উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে আমাকে জয়িতা নারী হিসাবে সম্মাননা দেয়। 

আয়েশা বেগম আরও বলেন, উপজেলা সদরে যে ঘরে আমি বসবাস করতাম, সেখান থেকে আমাকে কিছু ষড়যন্ত্রকারী উচ্ছেদ করেছে। এখন আমি দোকানেই রাত্রি যাপন করি।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে হোটেলে খেতে আসা উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের ইউসুফ তালুকদার এবং ওয়াগ্গা ইউনিয়নের বাবলু বিশ্বাস অমিত বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কাজে আসলেই প্রায় দিনই খাওয়া হয় এই হোটেলে। অত্যন্ত ঘরোয়া পরিবেশে রান্না করা খাবার তিনি পরিবেশন করেন। তারা উভয়ই জানান, ওই মহিলা খুব পরিশ্রমী। নিজে রান্না করে আবার পরিবেশনও করেন।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রিনি চাকমা জানান, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর হতে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) এবং ৯ ডিসেম্বর  বেগম রোকেয়া দিবস উদযাপন উপলক্ষে বিভিন্ন প্রতিকূলতাকে জয় করে সফল হয়েছেন এমন ৫ ক্যাটাগরীর নারীদের তথা জয়ীতাদের চিহ্নিত করে যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায়, ২০২১ সালে জীবন সংগ্রাম করে প্রতিকূলতাকে জয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া কাপ্তাই উপজেলার বড়ইছড়ি এলাকার আয়েশা বেগমকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, কাপ্তাই কর্তৃক "অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী" হিসাবে সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়া হয়। আমি মনে করি, আয়েশা বেগম আমাদের সমাজের অসহায় স্বামীহারা নারীদের জন্য একটি উদাহরণ। তার জীবন সংগ্রাম দেখে অন্য নারীরাও এগিয়ে আসতে পারে।

সম্পর্কিত বিষয়:

জনপ্রিয়