রাঙামাটি । বুধবার, ১৫ মে ২০২৪ , ৩১ চৈত্র ১৪৩১

নিউজ ডেস্কঃ-

প্রকাশিত: ১০:০৩, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল: এখনো অরক্ষিত উপকূল

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল: এখনো অরক্ষিত উপকূল
সংগৃহীত ছবি

আজ ভয়াল ২৯ এপ্রিল। স্বজনহারাদের আঁতকে ওঠার দিন। এখনো স্বজনরা ডুকরে ডুকরে কাঁদে প্রিয়জনের স্মরণে। গণহারে কবর হয়েছিল, লাখ লাখ মরেছে মানুষ। মানুষের লাশ আর লাশ ভেসে এসেছে সেদিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল দেশের উপকূলীয় জনপদ।

এদিন প্রায় আড়াইশ’ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত এবং ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস তছনছ করে দিয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। সেদিনের ঘটনায় দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। ১ কোটি মানুষ তাদের সর্বস্ব হারায়। বিশেষ করে মহেশখালী ধলঘাটা, মাতারবাড়ি ও কুতুবজোমের ২ লক্ষাধিক মানুষ বসতবাড়ি হারিয়ে ফেলে। যারা পরবর্তীতে কক্সবাজার সদরের নাজিরাটেক, চরপাড়া, সমিতি পাড়াসহ কক্সবাজার চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে আশ্রয় নেয়।

দেশে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়ে কেউ কেউ বাবা, মা আবার কেউ কেউ ভাই-বোনসহ স্বজনদের হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল।

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়টি ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ছয় মিটার (২০ ফুট) উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয় এবং এতে প্রায় এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

এদের বেশিরভাগই নিহত হয় চট্টগ্রাম জেলার উপকূল ও দ্বীপসমূহে। সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া মহেশখালী, হাতিয়া দ্বীপে নিহতের সংখ্যা সর্বাধিক। শুধু সন্দ্বীপেই মারা যায় প্রায় ২৩ হাজার লোক। আর কক্সবাজারে মারা যায় ৮৬ হাজার লোক।

ধারণা করা হয়, এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে। সাগর ও নদীর উপকূল প্লাবিত হয়। কর্ণফুলী নদীর তীরে কংক্রিটের বাঁধ থাকলেও এটি জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ১০০ টন ওজনের একটি ক্রেন ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে স্থানচ্যুত হয় এবং আঘাতের কারণে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। বন্দরে নোঙর করা বিভিন্ন ছোট বড় জাহাজ, লঞ্চ ও অন্যান্য জলযান নিখোঁজ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরমধ্যে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অনেক যানও ছিল। এছাড়া প্রায় ১০ লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২৯ এপ্রিলের সেই ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি বয়ে উপকূলীয় মানুষের কাছে দিনটি ফিরে আসে বার বার। দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। প্রলয়ংকরী এই তাণ্ডবের ৩৪ বছর পরও উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি। অরক্ষিত উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের খবর শুনলে এখনো নির্ঘুম রাত পার করেন অনেকে। 

আনোয়ারা রায়পুরে এখনো স্থায়ী বেড়িবাঁধ হয়নি। রায়পুর ইউনিয়নের বারআউলিয়া, বাইঘ্যার বাড়ি, গলাকাটার ঘাট অংশে ব্লক দেওয়া হয়েছে। ছত্তার মাঝির ঘাট ও পারুয়াপাড়া এলাকার কিছু অংশে ব্লক দেওয়ার কাজ চলমাল রয়েছে। উপজেলার গহিরা এলাকা পুরোটাই বেড়িবাঁধের আওতায় আসছে।

২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে আঘাতহানা প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল সীতাকুণ্ডের সলিমপুর থেকে সৈয়দপুর পর্যন্ত ৯টি ইউনিয়ন। প্রায় ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগ সম্পন্ন ও ৩০-৩৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে উপকূল পরিণত হয়েছিল বিরাণ ভূমিতে। এ সময় মারা গিয়েছিল এলাকার প্রায় সাত হাজার মানুষ। আর নিখোঁজ হয়েছিল প্রায় ২০ হাজার শিশু-নারী-পুরুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় তিনশ কোটি টাকার সম্পদ। উপকূলের আংশিক বেড়িবাঁধ সংস্কার হলেও এখনো এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।

কুমিরা, বাঁশবাড়িয়া, সোনাইছড়ি, ভাটিয়ারিসহ উপকূলীয় এলাকায় গত ৩০ বছরে বেড়িবাঁধ নির্মাণের নামে কয়েকশ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বাঁশবাড়িয়ার বোয়ালিয়াকূল বেড়িবাঁধ দীর্ঘদিন পর সংস্কার হলেও এর স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, আনোয়ারা উপকূলের বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এছাড়া খালের বেড়িবাঁধও নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে বিগত দুই বছর কাজ কিছুটা থমকে ছিল। বর্তমানে পুরোদমে চলছে প্রকল্পের কাজ। আশা করছি শিগগিরই উন্নয়ন কাজ শেষ হবে।

১৯৯১ সালের এইদিনকে স্মরণ করে ঘূর্ণিঝড়ে নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় প্রতি বছর ২৯ এপ্রিল ঘরে-ঘরে মিলাদ মাহফিল, কোরআনখানি, দোয়া কামনা, দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণসহ বিভিন্ন আয়োজনে দিনটি পালন করে আনোয়ারা, বাঁশখালী, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া,পেকুয়াসহ সমগ্র উপকূলীবাসী।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে  কক্সবাজার উপকূলের মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার একর জমি সাগর গর্ভে বিলীন হয়েছে। এখনো এ জমি সাগর গর্ভে তলিয়ে আছে। আর বেড়িবাঁধের ৫৯৬ বর্গ কিলোমিটারের মধ্য প্রায় ৮০শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।